Rath Yatra History: জগন্নাথের রথযাত্রার ইতিহাস, রীতিনীতি ও নিয়ম

Rath Yatra History: জগন্নাথের রথযাত্রার ইতিহাস, রীতিনীতি ও নিয়ম

হিন্দুধর্মের মানুষের কাছে একটি অন্যতম গুরুত্বপূ্র্ণ উত্‍সব হল রথযাত্রা। কিন্তু এই রথযাত্রার ইতিহাস, রীতিনীতি ও সমস্ত নিয়ম-কানুন (Rath Yatra history, rituals and rules) সম্পর্কে আমরা বেশির ভাগ মানুষই জানি না। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা বা পুরী নয়, ভারতের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রথযাত্রা পালিত হয়। দেশে-বিদেশে রথ উপলক্ষ্যে আয়োজিত শোভাযাত্রায় ভক্তদের ঢল নামে প্রতি বছর। রথযাত্রার বিকেলে পাড়ার বাচ্চাদের ছোট ছোট রথ নিয়ে বেরোতে দেখেছি আমরা সবাই। এই প্রাচীন ধর্মীয় ও সামাজিক উত্‍সব সম্পর্কে বেশ কয়েকটি জানা-অজানা তথ্য আজকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলো।

রথযাত্রার ইতিহাস (Rath Yatra history)

প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। জগন্নাথ দেব হলেন শ্রীবিষ্ণুর অবতার। ওই দিন ভগবান জগন্নাথ দেব, তার দাদা বলরাম বা বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রাকে নিয়ে রথে চেপে মাসি গুণ্ডিচার বাড়িতে বেড়াতে যান, এবং এক সপ্তাহ সেখানে থাকার পর ফিরে আসেন। ভগবানের এই রথে চেপে যাত্রাকেই ‘রথযাত্রা’ নামে ডাকা হয় থাকে।

উড়িষ্যার পুরীতে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে এই যাত্রা উপলক্ষ্যে সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয় প্রতি বছর। আজ থেকে ৪৬০ বছরেরও বেশি পুরনো সাহিত্যেও এই উত্‍সবের উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি পদ্ম পুরাণ, ব্রহ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ এবং কপিল সংহিতার মতো প্রাচীন শাস্ত্র সাহিত্যেও রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়।

পুরীর মন্দিরের সামনে রথযাত্রা উৎসবের প্রস্তুতি / Preparations for Puri Rath Yatra festival in front of the Puri Mandir
পুরীর মন্দিরের সামনে রথযাত্রা উৎসবের প্রস্তুতি / Preparations for Puri Rath Yatra festival in front of the Puri Mandir

রথযাত্রা উৎসবের রীতিনীতি ও নিয়ম-কানুন (Rath Yatra rituals and rules)

১) স্নান যাত্রার দিন জগন্নাথ দেবকে ১০৮ কলসি জলে স্নান করানো হয়। যার ফলে সর্দি জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি, দাদা বলরাম এবং বোন সুভদ্রা।

২) অসুস্থ হয়ে পড়ার ফলে তিন ভাইবোনকে ১৪ দিন পৃথক একটি কক্ষে রাখা হয়। রোগভোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর রথে চড়ে তিন ভাইবোন মাসি গুন্ডিচা দেবীর বাড়িতে বেড়াতে যান।

৩) জগন্নাথ দেব বলরাম এবং সুভদ্রা আষাঢ় মাসের দশমীর দিনে মাসি গুন্ডিচা মন্দির থেকে উল্টো রথযাত্রা করে  ফিরে আসেন।

৪) জগন্নাথ দেবের রথ তৈরি শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে।

৫) রথ তৈরির কাজে প্রায় ২ মাস সময় অতিবাহিত হয়। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য প্রতি বছর নিম কাঠ দিয়ে তিনটি পৃথক রথ নির্মাণ করা হয়। বসন্ত পঞ্চমীর দিন থেকে দশপল্লার জঙ্গল থেকে কাঠ একত্রিত করা শুরু হয়।

৬) তিন জনের রথের রং আলাদা আলাদা। জগন্নাথ দেবের রথের রং লাল ও হলুদ। বলরামের রথের রং লাল ও সবুজ। সুভদ্রার রথের রং কালো অথবা নীল ও লাল।

৭) রথ বানানোর কাজে ২০০-র বেশি সেবায়েত নিযুক্ত থাকে। রথ তৈরিতে কোনও ধরনের পেরেক ব্যবহার করা হয় না।

৮) প্রতি বছরই আগের বছরের রথটি ভেঙে ফেলা হয়। এবং সেই রথের কাঠ দিয়ে খেলনা তৈরি করা হয়।

রথ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা

১) শোনা যায় পুরীর রাজা সোনার ঝাঁটা দিয়ে পথ পরিস্কার না করে দেওয়া পর্যন্ত হাজার লোক মিলে রথের দড়ি ধরে টানলেও রথ একচুলও এগোয় না। এই অনুষ্ঠানটিকে ‘ছর পহনরা‘ নামে ডাকা হয়।

২) তিন জনের তিনটি রথের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। জগন্নাথ দেবের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ‘ বা ‘গরুঢ়ধ্বজ‘। বলরামের রথের নাম ‘তালধ্বজ‘। সুভদ্রার রথের নাম ‘দর্পদলন‘ বা ‘পদ্মরথ‘।

৩) তিনটি রথের উচ্চতাও এক নয়। বলরামের রথ সবার আগে থাকে, এর উচ্চতা ৪৫ ফুট। মাঝখানে থাকে সুভদ্রার রথ, এর উচ্চতা ৪৪.৬ ফুট। শেষে থাকে জগন্নাথের রথ থাকে একেবারে পিছনে, এর উচ্চতা ৪৫.৬ ফুট।

পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস (Puri Rath Yatra history)

হিন্দু পুরাণমতে, এবং রথযাত্রার ইতিহাস (Rath Yatra history) অনুযায়ী, আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেব রথে চড়ে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে দেখতে আসেন। সেই উপলক্ষ্যে ওই তিথিতে পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার আয়োজন হয়। রথযাত্রার সাত দিন পর উল্টোরথ যাত্রা পালন করা হয়। উড়িষ্যায় গঙ্গা রাজবংশ ১১৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে পুরীর মন্দির স্থাপন করে রথযাত্রার সূচনা করে।

পড়ুন -> History of Holi: কেনো পালন করা হয় হোলি? জেনে নিন দোল পূর্ণিমা সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য

পুরীতে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ির সামনে রথে ভক্তদের সমাগম / Devotees gather in Rath in front of Jagannath Dev's 'Masir Bari' in Puri
পুরীতে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ির সামনে রথে ভক্তদের সমাগম / Devotees gather in Rath in front of Jagannath Dev’s ‘Masir Bari’ in Puri

বাংলার বিভিন্ন রথযাত্রার ইতিহাস (West Bengal Rath Yatra history)

উড়িষ্যার সাথে সাথে বাংলার রথযাত্রার ইতিহাসও কিন্তু বেশ পুরনো। এমনিতেই বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। সেই বাংলা ধুম ধাম করে রথ টানবে না, টা কি করে হয়? বহু কাল আগে থেকেই বাংলার নানা প্রান্তে মহা সমারোহে রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। কলকাতা শহরের পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে মহারম্বরে পালিত হয়ে থাকে রথযাত্রা উৎসব। নিচে তেমনই কিছু রথযাত্রা উৎসবের হদিশ দেওয়া হলো।

কলকাতার কিছু পুরনো রথযাত্রার ইতিহাস (Kolkata Rath Yatra history)

সেই ইংরেজ আমল থেকেই কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে কিছু বনেদী পরিবারে মহা সমারোহের সাথে রথযাত্রা উত্‍সব পালিত হয়ে আসছে। তার মধ্যে যেমন উল্লেখযোগ্য হলো উত্তর কলকাতার প্রামাণিক বাড়ির রথযাত্রা উত্‍সব। এই পরিবারে আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে থেকে এই রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। এছাড়া রয়েছে শশীভূষণ দে স্ট্রিটের গৌরাঙ্গ মন্দিরের রথযাত্রা উত্‍সব।

কলকাতায় ইসকনের রথযাত্রার ইতিহাস (Kolkata ISKCON Rath Yatra history)

১৯৭২ সাল থেকে এই রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। কলকাতার ইসকন মন্দিরটি অবস্থিত এলগিন রোডে। প্রতি বছর প্রবল উন্মাদনা  ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয় এই রথযাত্রা উত্‍সব। ইসকনের এলগিন রোডের মন্দির থেকে রথযাত্রা বেরিয়ে তা শেষ হয় এমজি রোডের মল্লিকদের ঠাকুরবাড়িতে। আবার সাত দিন পর উল্টো রথের দিন একই পথে ফিরে আসেন জগন্নাথ দেব-বলরাম-সুভদ্রাকে।

মাহেশের রথযাত্রার ইতিহাস (Mahesh Rath Yatra history)

এপার বাংলার বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে মহেশের রথ। প্রতি বছর হুগলির শ্রীরামপুরে মাহেশের রথযাত্রা উত্‍সব পালিত হয়। ১৩৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। সারা দেশের মধ্যে হুগলির মাহেশের রথযাত্রা উৎসব দ্বিতীয় প্রাচীনতম।

বাঁকুড়ার রথযাত্রার ইতিহাস (Bankura Rath Yatra history)

বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে রথযাত্রা প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো। এই রথ যাত্রার রথ নির্মিত হয় পাঁচচূড়া মন্দিরের অনুকরণে। তবে বাঁকুড়ার রথের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণত অন্য সমস্ত রথযাত্রায় রথে সাওয়ার হন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা। কিন্তু বাঁকুড়ার রথে সবার হন শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল জিউ।

পুরুলিয়ার রথযাত্রার ইতিহাস (Purulia Rath Yatra history)

১৮৯৮ সালে পুরুলিয়ার চকবাজারে এক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুন্নি বাই নামে এক বাইজি। পরবর্তীতে সেই মন্দিরে রাধা গোবিন্দ জিউর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত করে রথযাত্রা উৎসব পালন করা হয়। মুন্নি বাইজির এই রস উৎসব প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো। তবে বর্তমানে এই রথযাত্রা উৎসব পালন করার দায়িত্ব রয়েছে স্থানীয় কয়াল পরিবারের হাতে।

বর্ধমানের রথযাত্রার ইতিহাস (Bardhaman Rath Yatra history)

রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতোই বর্ধমানেও বেশ দমদম এর সাথে পালিত হয় রাধাবল্লভের রাজবাড়ীর রথযাত্রা উৎসব। শোনা যায় শ্রীচৈতন্যদেব একবার জামালপুরের কুলীন গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন। পুরীর রথের রশি ইঁদুরে কেটে দেওয়ায় শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য সত্য রাজকে কুলীন গ্রাম থেকে নতুন রশি আনতে বলেছিলেন শ্রী চৈতন্যদেব। সেই রীতি মেনে আজও কুলিনগ্রাম থেকে রথের রশি পাঠানো হয় পুরীতে।

শিলিগুড়ির রথযাত্রার ইতিহাস (Siliguri Rath Yatra history)

উত্তরবঙ্গে যে সমস্ত রথ উৎসব পালন করা হয় তাদের মধ্যে শিলিগুড়ির রথ উৎসব অন্যতম। ইসকনের তরফ থেকেও শিলিগুড়িতে রথযাত্রা পালন করা হয়ে থাকে। এই রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠে গোটা শিলিগুড়ি শহর।

কোচবিহারের রথযাত্রার ইতিহাস (Cooch Behar Rath Yatra history)

উত্তরবঙ্গের অপর এক বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব হল কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরের রথযাত্রা উৎসব। কোচবিহারের রাজার আমল থেকেই রথযাত্রা দিনে ভগবান মদনমোহন রথে চড়েন। সেই প্রাচীন রীতি মেনে আজও পালিত হয়ে আসছে মদন মোহন রথযাত্রা উৎসব।


রথযাত্রার ইতিহাস (Rath Yatra history) সম্বন্ধে আরও জানতে পড়ুন উইকিপিডিয়ার এই পাতা

এরকম আরো খবর পেতে চোখ রাখুন বেঙ্গলি নিউজ ৩৬৫ এর পাতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *