Bengali Wedding: বাঙালি বিয়ের সমস্ত রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য

Bengali Wedding: বাঙালি বিয়ের সমস্ত রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য

অগ্নি দেবতাকে সাক্ষী রেখে সিঁদুর পরিয়ে, মাল্যদান করে দুটো মানুষ চিরদিনের মত একে অপরের সুখ দুঃখে পাশে থাকার দায়িত্ব নেওয়ার নামই হচ্ছে বিবাহ। সব ধর্মেই বিয়ের কিছু আচার অনুষ্ঠান থাকে। তবে বাঙালি বিয়ে (Bengali wedding) যেন বাঙালির ঐতিহ্য, রীতিনীতির এক অসাধারণ উপস্থাপন।

বিবাহ শব্দটির অর্থ

‘বিবাহ’ শব্দটি মাত্র তিন অক্ষরের হলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ ভীষণ গভীর। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, বিবাহ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো ‘বিশেষভাবে বহন করে নিয়ে যাওয়া’। এই বহন শুধু দুটো মানুষের শরীরকে বহন করা নয়। এই বহনের অর্থ হল দুটো সম্পর্ককে আমরণ বহন করে নিয়ে যাওয়া। তবে আজকাল বাঙালিরা কিন্তু কখনোই চলতি কথায় ‘বিবাহ’ শব্দটি মুখে উচ্চারণ করে না। আসলে এটি শুদ্ধ বাংলার একটি শব্দ। ‘বিবাহ’ শব্দটির বদলে ‘বিয়ে’ কথটিই চলতি কথায় বেশি প্রচলিত।

বাঙ্গালদের ও ঘটিদের বিয়ের নিয়ম-কানুন

পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত বাঙালিদের ‘বাঙাল‘ এবং প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় পশ্চিমবঙ্গে থাকা বাঙালিদেরকে ‘ঘটি‘ বলা হয়ে থাকে। এই বাঙাল এবং ঘটিদের কিন্তু বিয়ের নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন। তবে বর্তমানে বাঙ্গালদের সাথে ঘটি বা ঘটিদের সঙ্গে বাঙ্গালদের বিয়ে হামেশাই হয়ে থাকে।

এই পাতায় বাঙালি বিয়ের (Bengali Wedding) প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব নিয়মকানুন বলা রইল।

Bride and groom in Bengali wedding / বাঙালি বিয়েতে বর ও বউ
Bride and groom in a Bengali wedding / বাঙালি বিয়েতে বর ও বউ

পাকা দেখা বা ‘পাটিপত্র

বিয়ের আগে সর্বপ্রথম হয় পাকা দেখা বা ‘পাটিপত্র’। যখন ছেলের বাড়ি ও মেয়ের বাড়ি উভয়েই বিয়ের জন্য রাজি হয়, তখন একটি শুভ দিন দেখে তারা একত্র মিলিত হয়। সাধারণত এই দিন ছেলে এবং মেয়ে উভয় পক্ষেরই বাবা-মা, বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুজনরা সব একসাথে বসে কথাবার্তা পাকা করে। এই দিনটিকে ঘটিদের বাড়িতে বলা হয় পাকা কথা এবং বাঙ্গালদের বাড়িতে বলা হয়ে থাকে পাটিপত্র। কবে বিয়ে এবং বিয়েতে যা যা আচার অনুষ্ঠান রয়েছে, সমস্ত কিছু কথাবার্তা উভয়পক্ষের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে কাগজ কলমে লিখিত হয় এই দিন।

আশীর্বাদ

বাঙালি বিয়ের (Bengali Wedding) নিয়ম অনুযায়ী ছেলে ও মেয়ের বাড়ির উভয় পক্ষের মধ্যে পাকা দেখা বা পাটিপত্র সম্পন্ন হয়ে গেলে একটি শুভ দিন দেখে আশীর্বাদ করা হয়। পাত্রের পক্ষ থেকে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে পাত্রীকে আশীর্বাদ করা হয়। আবার অপরদিকে পাত্রীর বাড়ি থেকে অভিভাবকেরা এসে পাত্রকে আশীর্বাদ করে যায়।

আবার অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের দিনও লগ্ন শুরু হওয়ার আগে পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকে এসে কনেকে আশীর্বাদ করে দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় পাত্রীর বাড়ি থেকেও বিয়ের দিন সকালে বা কোনো ভালো সময় গিয়ে পাত্রকে আশীর্বাদ করে আসা হয়।

বিয়ের কেনাকাটা

যেহেতু পাকা দেখা বা পাটিপত্রের দিনে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়, তো সেই হিসেবেই এবার বিয়ের প্রস্তুতি পর্ব নিতে হয় উভয়ের পক্ষের। প্রথমেই বর-কনের পোশাক কেনার পালা। সাধারণত হিন্দু বাড়িতে কনেরা লাল বেনারসি পড়ে থাকে বিয়ের দিন এবং বর পড়ে থাকে ধুতি-পাঞ্জাবি। এছাড়া উভয়ের জন্যই প্রয়োজন হয় শাড়ি বা পাঞ্জাবির সাথে মানানসই জুতো, ব্যাগ, রুমাল ইত্যাদি।

বিয়ের জোর কেনা হয়ে গেলে এক এক করে গায়ে হলুদের পোশাক, প্রণামির জামাকাপড়, শুভরাত্রির জামাকাপড় ইত্যাদি অনেক পোশাক কিনতে হয়।

আইবুড়ো ভাত

আসলে বিয়ের আগে অবিবাহিত ছেলে বা মেয়েকে আইবুড়ো বলা হয়ে থাকে এবং বাংলায় প্রবাদ আছে যে বিয়ের পর নাকি বলা হয় ‘আইবুড়ো নাম ঘুচলো’। তাই বিয়ের আগে আগে ছেলে এবং মেয়েদের তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধবরা নিমন্ত্রণ করে খাইয়ে থাকে। এই নিয়মটিকে বলা হয় আইবুড়ো ভাত। এছাড়া বিয়ের ঠিক আগের দিন ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের বাড়িতে যে খাওয়ার আয়োজন করা হয়ে থাকে, তাকেও বলা হয় আইবুড়ো ভাত। এই আইবুড়োভাতে পাঁচ রকম ভাজা, মাছের মাথা, মাছ, মাংস, পায়েস ইত্যাদি সাজিয়ে দেওয়া হয় বর এবং কনের সামনে।

'Aiburo Bhaat' ritual before Bengali weddings / বাঙালি বিয়ের পূর্বে আইবুড়ো ভাত খাওয়ানোর রীতি
‘Aiburo Bhaat’ ritual before Bengali weddings / বাঙালি বিয়ের পূর্বে আইবুড়ো ভাত খাওয়ানোর রীতি

গঙ্গা পুজো

বিয়ের আগের দিন সন্ধে নাগাদ অথবা কোন কোন বাড়িতে বিয়ের আগের দিন রাত্রেবেলা বা মাঝরাতে বাড়ির কাছাকাছি কোন পুকুর বা নদীতে পান-সুপারি ও বরণকুলো নিয়ে মা গঙ্গাকে দিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসতে হয়।

শাঁখা পলা পরা

কোন কোন বাড়িতে নিয়ম থাকে বিয়ের আগের দিন কনেকে শাখা-পলা পড়তে হয়। আবার কোন কোন বাড়িতে বিয়ের দিন ভোরবেলাও শাখা-পলা পড়ানো হয়ে থাকে। বাঙালি বিয়েতে (Bengali Wedding) কনেরা হাতে শাখা-পলা পড়ে। হিন্দু শাস্ত্রে মানা হয় একজন সধবা স্ত্রী সারাজীবন তার স্বামীর মঙ্গল কামনায় এই শাখা-পলা পড়ে থাকবে।

দধিমঙ্গল

বিয়ের দিন ভোরবেলা ঠাকুর প্রণাম করে কনে এবং বর উভয়কেই চিরে দই খাওয়ানো হয়ে থাকে। এই নিয়ম রীতিকে বলা হয় দধিমঙ্গল। এরপরে বর এবং কনে উভয়ই বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত কিছুই মুখে দিতে পারে না।

বৃদ্ধি পুজো

দধি মঙ্গলের বেশ খানিকটা সময় পর পুরোহিত একটি পুজো করেন। যেখানে কনের বাড়িতে কনে এবং বরের বাড়িতে বরকে উপস্থিত থাকতে হয়। আর অবশ্যই তার কোন পিতৃস্থানীয় অভিভাবককে পুজোটি সম্পন্ন করতে হয়। একে বলা হয় বৃদ্ধি পুজো। বাঙালি বিবাহের (Bengali Wedding) রীতি মেনে সাধারণত সব বাড়িতেই বাবারা এই বৃদ্ধি পুজো করে থাকেন। কারো কারো ক্ষেত্রে বাবার অবর্তমানে দেখা কাকা, জেঠা অথবা মামা এই পুজোতে বসতে পারেন।

জল সইতে যাওয়া

পরপরই পাত্র-পাত্রী উভয় বাড়িতে মহিলারা সকলে কলসি নিয়ে পুকুর থেকে জল আনতে যায়। নিয়ম অনুযায়ী, পাঁচ জন সধবার স্ত্রী একে অপরকে ছুঁয়ে পুকুর থেকে জল ভরে নিয়ে আসে। আর সেই জল দিয়েই বর ও কনেকে স্নান করাতে হয়।

গায়ে হলুদ

বাঙালি বিয়ের (Bengali wedding) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মজার অনুষ্ঠান হচ্ছে গায়ে হলুদ। বাঙালি বিয়েতে বরকে প্রথমে হলুদ মাখানো হয়। বরের গায়ে ছোওয়ানো হলুদ নিয়ে বরপক্ষ কনে পক্ষের বাড়িতে আসে। তারপর সেই হলুদ দিয়ে কনেকে স্নান করানো হয়। এই সময় উভয় বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা অনেক মজা করে থাকে। একে অপরকে হলুদ মাখিয়ে থাকে।

'Gaye holud' or 'Gatro horidra' ritual before Bengali weddings / বাঙালি বিয়েতে গায়ে হলুদ বা 'গাত্র-হরিদ্রা'
‘Gaye holud’ or ‘Gatro horidra’ ritual in Bengali weddings / বাঙালি বিয়েতে গায়ে হলুদ বা ‘গাত্র-হরিদ্রা’

জামাই বরণ

এরপর বিয়ের দিন বিকেলে নির্দিষ্ট সময়মতো পাত্রপক্ষ পাত্রকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে কনের বাড়িতে। নিয়ম অনুযায়ী, কনের মা বরণকুলো দিয়ে জামাইকে বরণ করে এবং মিষ্টিমুখ করিয়ে স্বাগত জানায়।

সাত পাক ঘোরা ও শুভদৃষ্টি

এরপর শুরু হয় বিয়ের আচরণ অনুষ্ঠান। বর-বউ একসঙ্গে সাত পাক ঘোরে এবং ছাদনাতলায় প্রথম বর-কনে একে অপরকে দেখে একে বলা হয় শুভদৃষ্টি।

মালা বদল

বর ও কনের উভয়ের গলাতেই বরমাল্য থাকে। শুভদৃষ্টির পর একে অপরকে তাদের গলার মালা পরিয়ে দেয়। এইভাবে হয় মালা বদল।

কন্যা সম্প্রদান

বাঙালি বিয়ের (Bengali Wedding) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক একটি নিয়ম হল কন্যা সম্প্রদান। কারণ এই সময় একজন বাবা তার মেয়েকে তার বরের হাতে চিরদিনের মত তুলে দেয়। তার মেয়ের পরবর্তী জীবনের ভালো থাকা, খারাপ থাকা সবকিছুর দায়িত্ব তিনি তার মেয়ের স্বামীর হাতে সঁপে দেন।

হোম যজ্ঞ

এরপর পুরোহিত হোম যজ্ঞ শুরু করেন। সেই হোমের আগুনকে সাক্ষী রেখে বর-কনে একে অপরের সারাজীবন পাশে থাকার শপথ নেয়। হোমের আগুনে কুলো করে খই ফেলতে হয়।

সিঁদুর দান

বর কনে উভয় উভয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর কোণের সিঁথি রাঙা করে বর সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে একটি শাড়ি দিয়ে কনের মুখকে ঢেকে দেওয়া হয়। ওই শাড়িটিকে বলা হয় লজ্জা বস্ত্র। হিন্দু মতে, এই সিঁদুর হল নারীর আসল সম্পত্তি। স্বামীর সর্বদা মঙ্গল চেয়ে কনেকে সিঁদুর পড়তে হয় আজীবনকাল।

'Sindur Daan' ritual in Bengali weddings / বাঙালি বিয়েতে সিঁদুর দান
‘Sindur Daan’ ritual in Bengali weddings / বাঙালি বিয়েতে সিঁদুর দান

বিবাহ বাসর

বিয়ের দিন নতুন বর কনেকে নিয়ে তাদের বন্ধু-বান্ধবরা রাত জাগে, গান-বাজনা করে, হাসি ঠাট্টা করে। একে বলা হয় বিবাহ বাসর জাগা।

বাসি বিয়ে

বাঙালি বিয়েতে (Bengali Wedding) সকাল বেলায় কনের বাড়িতে বেশ কিছু নিয়মকানুন থাকে। অনেক সময় অনেক অনেক পরিবারে বিয়ের দিন সিঁদুর না পরিয়ে, বাসি বিয়ের দিন সিঁদুর পড়ানো হয়ে থাকে।

কন্যা বিদায়ী

এরপর আসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নিয়ম, সেটি হল কন্যা বিদায়ী। বাবা-মা তার মেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করে মেয়েকে পাঠিয়ে দেন তার নতুন জীবনের জন্য স্বামীর ঘরে।

বধূবরণ

বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে কনে পা রাখে একদম নতুন একটি জীবনে নতুন একটি বাড়িতে। অর্থাৎ তার স্বামীর বাড়িতে। এই সময় তার শাশুড়ি মা বরণকুলো দিয়ে তার বউমাকে বরণ করে নেয়। এই নিয়মটির নাম বধূবরণ।

কালরাত্রি

বধূবরণ এর পরপর সেই দিনটি স্বামী এবং স্ত্রী আলাদা থাকে। বাঙালি বিয়ের (Bengali Wedding) নিয়ম অনুযায়ী, ঐদিন সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত স্বামী তার নতুন বউয়ের মুখ দেখতে পারবে না, তাতে নাকি অমঙ্গল ঘটতে পারে। একে কালরাত্রি বলে। রাত্রি কেটে ভোরবেলা কাক ডাকার আগে তাদেরকে বেলপাতা দিয়ে জলের ছিটে দেওয়ার পর তারা একে অপরের মুখ দেখতে পারে।

ভাত কাপড়

বউকে নিয়ে আসার পরের দিন দুপুরবেলা স্বামী একটি থালায় শাড়ি, আলতা, সিঁদুর এবং অপর একটি থালায় ভাত, পাঁচরকম ভাজা, মাছের মাথা, মাছ ইত্যাদি পদ সাজিয়ে তার স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বলে যে আজ থেকে স্বামী তার স্ত্রীর সমস্ত দায়িত্ব বহন করবে। এই নিয়মটির নাম হচ্ছে ভাত কাপড় অনুষ্ঠান।

বৌভাত

বাঙালি বিয়ের (Bengali Wedding) সর্বশেষ আচার অনুষ্ঠানটি হল ‘বৌভাত’। এই দিন দুপুরবেলা নতুন বউ তার নতুন পরিবারের সমস্ত সদস্যের পাতে ঘি ভাত পরিবেশন করে থাকে। এরপর হয় সন্ধ্যের অনুষ্ঠান। এখানে কনে পক্ষ থেকে বরপক্ষের বাড়িতে কন্যাযাত্রী আসে। কনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আবার ফিরে যায়।

Bou Bhat / Reception after the completion of a Bengali Wedding / বাঙালি বিয়েতে সর্বশেষ অনুষ্ঠান 'বৌভাত'
Bou Bhat / Reception after the completion of a Bengali Wedding / বাঙালি বিয়েতে সর্বশেষ অনুষ্ঠান ‘বৌভাত’

শুভরাত্রি

বৌভাতের রাত্রিবেলায় প্রথম নতুন বর কনেকে এক ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কিছু নিয়ম কানুন পালন করে তারা একসাথে এক ঘরে থাকা শুরু করে।


এই রকম আরো খবর পেতে চোখ রাখুন বেঙ্গলি নিউজ ৩৬৫ এর পাতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *